এম এ জব্বার।
মানুষটা আমার জন্য অসাধারণ এক উপহার নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালের একটা গুলির বাক্স। (আমার জীবনে এমনিতেই জটিলতার শেষ নাই। তাই জটিলতা এড়াবার জন্য আমাদের দেশের চৌকশ গোয়েন্দাদের আগাম বলে রাখি, এই গুলির বাক্সটা খালি। মরচে ধরা, বাতিল, শতছিদ্র।)
আমার মত অগাবগা একজনের বাসায় এমন একজন মানুষ এসেছেন, এই আনন্দ কোথায় রাখি! কী খাওয়াই, কোথায় বসাই!
আহা, এঁর কাছে মন্ত্রী-ফন্ত্রী কোন ছার। অনেকে ভ্রু জোড়া দিয়ে বলবেন, অ, মিয়া, তোমার ওখানে কোনো মন্ত্রী তো পেশাব করতেও যাবেন না। তাঁদেরকে সবিনয়ে বলি, মন্ত্রীদের পেশাব করার সুব্যবস্থা আমার এখানে নাই।
১৯৭১ সালে এম এ জব্বার, এই মানুষটা পাকিস্তান থেকে আস্ত একটা রাশিয়ান T-55 ট্যাংক নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। জিটি রোড, ওয়াগা সেক্টরে মাইলের পর মাইল ট্যাংক চালিয়ে পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সীমান্তে চলে এসেছিলেন। কী এক পাগলামী, কী অকল্পনীয় এক কান্ড! ভাবা যায়?
ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করার পর চলে তাঁকে বিরামহীন জিজ্ঞাসাবাদ- মানুষটা কি পাকিস্তানী চর?
যাক সমস্ত প্রশ্নের সদুত্তর দেয়ার পর ভারতীয় সেনার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ঝাপিয়ে পড়েন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।
আজ মানুষটা বলে যাচ্ছেন। আমি শ্বাস আটকে শুনি সেইসব আগুন দিনের কথা, তাঁর অসম সাহসীকতার কথা। কতশত অজানা কথা! আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধা হোমো এরশাদ সাহেবের বীরত্বের কাহিনী (!)। তিনি এবং রওশন এরশাদ তখন পাকিস্তানে। ওখানে ওনারা উর্দুতে বাতচিত করতেন। যারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার জন্য ফাঁকফোকর খুঁজতেন তাদের প্রতি এরশাদ এবং তার বৌ উষ্মাও প্রকাশ করতেন উর্দুতে, 'শালে, তুমলোগ কে লিয়ে আমলোগ কা জিনা হারাম হো যাতা। ইন্ডিয়া তুমলোগ কা দিমাগ ঘুমা দিয়া'।
এরশাদ সাহেবের এইসব বাতচিত বাংলাতে অনুবাদ করলে অনেকটা দাঁড়াবে এমন: শালারা, তোমাদের জন্য আমাদের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে গেছে। ভারত তোমাদের মাথা এলোমেলো করে দিয়েছে।
আজ এই মানুষটা একজন সুখি মানুষ। তার আছে ভদ্রস্থ জীবন-যাপন করার সুযোগ। শুনে ভালো লাগে। তার গোলায় আছে ধান, পুকুরে মাছ। চমৎকার দিন চলে যায়।
তবুও মানুষটার কী এক হাহাকার! তাঁর সাহসীকতার জন্য তাঁকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়েছিল। লিখিতাকারেও আছে এটা কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রবাসে চলে গেলে এই বীরপ্রতীক খেতাবটা গেজেটে উঠেনি তদ্বিরের অভাবে। আজ তিনি একজন খেতাববিহীন মানুষ!
তাঁর আক্ষেপ আমার কানে তালা লাগিয়ে দেয়, "কেন আমাকে খেতাবের জন্য তদ্বির করতে হবে? কেন? আমি কি এইজন্য ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তান থেকে দেশে চলে এসেছিলাম? ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান একটা T-33 বিমান নিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তিনি এই দেশের বীরশ্রেষ্ঠ। তাঁকে আমি স্যালুট করি। আর আমি আস্ত একটা ট্যাংক নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসতে সফল হই কিন্তু আমাকে তদ্বির না করার অপরাধে একজন খেতাব বিহীন মানুষ হয়ে থাকতে হবে, কেন?"
এইসব ক্ষেত্রে আমি চুপ করে থাকি, আকাশ দেখি। ভুলেও সামনের মানুষটার চোখে চোখ রাখি না।
কারও কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিতে আমি আগ্রহ বোধ করি না কিন্তু এই মানুষটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, জোর করে আমার 'জীবনটাই যখন নিলামে' বইটায় তাঁর একটা অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। সযতনে রেখে দিয়েছি সেটা...।
*বক্তব্যগুলো জনাব এম, এ, জব্বারের নিজস্ব। তাঁর এইসব বক্তব্যর সপক্ষে প্রমাণ এবং সচিত্র-চলমান চিত্র (চালু নাম ভিডিও ক্লিপিংস) আমার কাছে সংরক্ষিত।
**আমার মাথায় নতুন এক ভূত আসন গেড়েছে। এখন থেকে এইসব আগুন-মানুষদের আনন্দ-বেদনা ভিডিও করে রাখব। এঁদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, পাল্লা দিয়ে কমছে আমার আয়ু। এ ব্যতীত আমার গতি কী! সুরুয মিয়ার আত্মহত্যা [১] (তাঁর প্রতি সালাম) ওইসব অজানা কথা তখন সেলফোনে ধারণ করে না রাখলে আজ কোথায় পেতাম?
এম, এ, জব্বারকে নিয়ে একটা সিরিজ লেখার ইচ্ছা আছে, দেখা যাক...। আপাতত এই মানুষটাকে খানিকটা সম্মান দিয়ে দায়শোধের চেষ্টা করা যায়...[২]
*মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত পোস্ট: http://tinyurl.com/37wksnh
সহায়ক সূত্র:
১. সুরুয মিয়ার আত্মহত্যা...: http://www.ali-mahmed.com/2009/08/blog-post_02.html
২. খানিকটা সম্মান দেখাবার চেষ্টা: http://www.ali-mahmed.com/2010/06/blog-post_4596.html
No comments:
Post a Comment