Search This Blog

Monday 18 January 2010

রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না

১.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪২ সাল। সোবিবর ডেথ ক্যাম্পে ২৯ হাজার বন্দীকে হত্যা করা হয়, অধিকাংশকেই গ্যাস চেম্বারে। সেখানে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন জন ইভান ডেমিয়ানইউর।
বছর যায়, পানি গড়ায়। জার্মানির লুদভিনাহাফন থেকে একটি সূত্র ধরে এই মানুষটিকে চিহ্নিত করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এখন তার বয়স ৮৯।
জার্মানির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১২ মে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স বিমানে করে
ইভান ডেমিয়ানইউরকে জার্মানির মিউনিখে পৌঁছে দেয়া হয়। তার বিচার শুরু হয়েছে।
অপরাধ প্রমাণিত হলে জার্মানীর যুদ্ধাপরাধ আইন অনুযায়ী এই মানুষটির বয়স বিবেচনা করে ১৫ বছর জেল হতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, এতো বছর পর এই বুড়া হাবড়াকে নিয়ে টানাটানি করা হচ্ছে কেন?
আদালতের ১৫০টি আসনের কোনটাই ফাঁকা থাকে না! একে আদালতে হাজিরা দিতে হয় হুইল চেয়ারে বসে, গোটা একটা প্লেন লেগেছে একে পৌছে দিতে।
এতো যন্ত্রণারই প্রয়োজন কী?

২.
৮০ বছর বয়স্ক পল ত্যুভিয়েরএকজন নাৎসি দালাল তিনি ২য় মহাযুদ্ধের সময় হত্যার উদ্দেশ্যেজন ইহুদীকে গেষ্টাপো বাহিনীর হাতে তুলে দেনওইজন ইহুদী আর কোন দিন ফিরে আসেননি! তিনি সাবেক ভিচি সরকারের গোয়েন্দা প্রধান ছিলেনপল ত্যুভিয়েরের মতো যারা স্থানীয় দালাল সহযোগী ছিলেন তাদের সাধারণভাবে যুদ্ধের পর ছাটাই করে রেহাই দেয়া হয়!
কিন্তু
, ১৯৭১ সালে মারশেখ ওপউলস-এর 'লা শাগ্রিন লা পিতি' মুভিটি দেখে ফরাসীরা উপলব্ধি করে যে, ফরাসীদের অনেক লজ্জাকর ইতিহাস রয়েছে! জনগণ ওই সব তথ্য ঢেক রাখার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, কিন্তু ১৯৭২ সালে জানা যায় যে, দালাল ত্যুবিয়েরকে প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করে দিয়েছিলেন!

বছর পর, মার্কিন ঐতিহাসিক রবার্ট প্যাক্সটনের বই 'ভিচি ফ্রান্স ওল্ড পার্ড এন্ড নিউ অর্ডার' পড়ে ছাত্ররা জানতে পারে, গোটা এক প্রজন্মের ইতিহাস! জানতে পারে যে, নাৎসীদের অপরাধের সঙ্গে কিছুসংখ্যক ফরাসীও অন্যায়ের সঙ্গে কতটা তীব্র ভাবে জড়িত ছিলবিশেষ করে নিহত ইহুদীদের সন্তান-সন্ততিদের কাছে সত্যটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে এতাদিন! সের্গেই কার্সফেল্ড সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ারহোক ৫০ বছর পর! (লা মদ) 

একটি ফরাসী আদালত এই মর্মে রুল জারী করেন, পল ত্যুভিয়ের-এর বিরুদ্ধে নাৎসী দালালের বিচার করা যাবেওই আদালত আরও বলেন: এই রুলিং, যুদ্ধাপরাধের ময়সীমা পার হয়ে গেছে বলে ত্যুভিয়েরের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা যাবে না বলে নিম্ন আদালতের যে রায় দিয়েছে তা নাকচ করা হলোআদালত আরও নির্দেশ দেন, মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য ত্যুভিয়েরের বিচার হবে, এই অপরাধের বিচারের কোন সময়সীমা নেই! (দ্য গার্ডিয়ান উইকলি/ ১৩ জুন ১৯৯৩)
এখানে যে জরুরি বিষয়টি উঠে এসেছে, অন্যায়ের বিচার হতে সময় কোন বাধা না। অন্যায়কারিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে তা যতো দেরিই হোক।

৩.
১ম বিশ্বযুদ্ধ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন কিছু সেনা, পালিয়ে যাওয়ার পেছনে তাঁদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য, যুক্তি ছিল পরে ভীরু কাপুরুষ নামে অভিহিত করে এসব সেনাদের ধরে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়কারণ দেখানো হয়, এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ! সেন্ট্রাল ইংল্যান্ডের স্ট্যানফোর্ডসায়ারের ন্যাশনাল মেমোরিয়াল আরবোরেটামে এঁদের সমাধিস্থল আছে দীর্ঘদিন ধরে এসব সেনাদের আত্মীয়স্বজনরা, নাতিপুতিরা জোর তদ্বির করে আসছিলেন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে, ওইসব সেনারা কোন ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেননিঅগাস্ট ০৬ বৃটিশ সরকার ঘোষণা করেছে তাদের অপরাধ ক্ষমার যোগ্য! 

সেই কবেকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ! ওইসব সেনাদের নাতিপুতিরা বছরের পর বছর ধরে এই লড়াইটা চালিয়ে গেছেন, এতো বছর পর এই সেনারা নির্দোষ প্রমাণিত হলে কী হয়? বিষয়টা এখানেই। বছরের পর বছর ধরে রক্তের দাগ বয়ে বেড়ানো কোন কাজের কাজ না। 

আমি মনে করি, ঘুষখোরকে ঘুষখোর বলা হবেসে ঘুষের পয়সায় কোটি টাকা দামের পোরসে হাঁকায়, না ঠেলাভ্যান; তাতে কি! আজকাল ঘুষখোরদের নিয় কোন উচ্চবাচ্য নাই। বটে রে, কেউ সেধে ঘুষ দেয় না- এদের হাতেও লেগে থাকে রক্ত! সামান্য একজন চাকুরে একেকজনের ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি; কেউ জানতে চাচ্ছে না, কোন আলাদিনের চেরাগ তার হাতেঅবলীলায় আমরা তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করছি, দিনে চৌদ্দবার সেলাম ঠুকছি! সত্যটা হচ্ছে, আজ থেকে ১০০ বছর পরও সে যে ঘুষখোর এটা বদলে যাচ্ছে না, ১৪ বার হজ করে আসলেও! নিজের শ্বশুর হলেও! 

গোলাম আজম দেশ চাননি, দেশের প্রতি যতো ধরনের অন্যায় করা সম্ভব, করেছেন তাঁর সঙ্গে কে উঠবস করেন, কে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তিনি কয়বার হজ করলেন, তাতে কি আসে যায়, সত্যটা তো আর পালটে যাচ্ছে না! 

অভিযুক্ত খুনি (প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ), তিনি পত্রিকা বের করলেন নাকি খেলার মাঠ দিলেন তাতে কী আসে যায়! জানি জানি অনেকে বলবেন, আদালতের রায় তো এখনও বের হয়নি। বেশ-বেশ, হাতের রক্তের দাগ মুছে না-যাওয়া পর্যন্ত অন্তত তার প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে তো কোন সমস্যা নেই। 

রাজাকারকে রাজাকার বলব, ছড়াকার না। কে তাকে কোলের বসিয়ে চুমু খেল, কে তাদের মেয়েকে বিয়ের নামে তাদের বিছানায় তুলে দিল তাতে কী আসে যায়! 
৩৯
বছর কেন, ৩৯০ বছর পরও সত্যটা এটাই থাকবে, যতো বিকৃত করা হউক না কেন, রক্তের দাগ মুছে ফেলা যায় না! আমরা ঘুষখোরকে ঘুষখোর- সুদখোরকে সুদখোর- রাজাকারকে রাজাকার- খুনিকে খুনি- গুখোরকে গুখোর- সাদাকে সাদা- কালোকে কালো, বলবই!

*ছবি স্বত্ব: শম্ভু সেনগুপ্ত, আগরতলা
, সংগ্রহে: দুলাল ঘোষ

No comments: