Search This Blog

Wednesday 5 August 2009

আমরা দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি

মুক্তিযোদ্ধা দুলা মিয়াকে (link)নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম।
এই অসমসাহসী বে-সামরিক মানুষটার সাহস দেখে সামরিক লোকজনরা পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ পর্যন্ত!

যুদ্ধে এই মানুষটার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল। গামছা দিয়ে বেঁধে গুলির পর গুলি চালিয়েছেন, পিছ-পা হননি। একজন মানুষের এমন সাহস রগরগে মুভিকেও হার মানায়! মানুষটা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁর ছোট্ট মেয়েটির তাগিদে। পরবর্তীতে এই মেয়েটির সম্বন্ধে কোথাও কোন তথ্য পাইনি। কিন্তু খুব ইচ্ছা করছিল মেয়েটির সম্বন্ধে জানার। সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন কেমন আছেন- কেমনই বা আছেন দুলা মিয়া নামের সিংহবলোকনন্যায় মানুষটা?

দুলা মিয়া বলেছিলেন, তিনি কুমিল্লার শালদানদিতে থাকেন। কিন্তু শালদানদি তো বিশাল এলাকা এবং পাহাড়ি অঞ্চল। কোথায়-কোথায় খুঁজব? তবুও বেরিয়ে পড়ি।

শালদানদির কেউ কিচ্ছু জানে না এই মানুষটা সম্বন্ধে। ‘অষ্টজঙ্গল’ নামের একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছি। নামের মতই জায়গা, ঝোপ-জঙ্গলের অভাব নাই! একজন মসজিদ রং করছিলেন, তিনি চিনতে পারলেন, 'আরে ওই ভটলা (মোটা) মানুষটা'।
মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানসূচক কোন বিষয়ে এখন আর অবাক হই না। তবুও বুকে ধক করে লাগে, চোখ ভিজে আসে। এমন একটা মানুষের প্রতি এমন পরিচিতি, অশ্রদ্ধা- হা ঈশ্বর! এলাকার লোকজনরা জানেই না এই মানুষটা দেশের জন্য কী করেছেন! কেন এদের জানানো হয়নি, এই দায় অবশ্যই আমাদের উপর বর্তায়।


অনেক চেষ্টায় তাঁর কবর নামের যে স্থান খুঁজে বের করি, নামফলক দূরের কথা কোন সামান্য চিহৃও নাই। এটা এবং জঙ্গলের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। অথচ পাশেই কোন এক অখ্যাত ফকিরের সমাধি দস্তরমতো টিন-ছনের ঘর বানিয়ে লালশালু দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। ভাগ্যিস, মখমল দিয়ে যে মুড়িয়ে রাখা হয়নি!
যে দেশের যে দস্তুর- এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। আমরা দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি, আমাদের আচরণে এর ব্যত্যয় হবে কেন? আমরা অসভ্য না হলে এমন একজন অগ্নিপুরুষকে এমন অবহেলায় ফেলে রাখব কেন? আর কেনই বা এক অখ্যাত ফকিরের সমাধি মাথায় তুলে রাখব!
এখন (১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯) এই ফকিরের সমাধি পাকা করা হচ্ছে, ক্রমশ জৌলুশপূর্ণ হবে।

কিন্তু তাঁর সেই ছোট্ট মেয়ের খোঁজ কেউ দিতে পারে না। কেউ বলল, এরা এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ঢাকায় চলে গেছে। ভাগ্যক্রমে খোঁজ পাওয়া যায়, তিনি নাকি বেড়াতে এসেছেন। অবশেষে সেই মেয়েটির মুখোমুখি হওয়া। বকুল আক্তার নামের সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ আর ছোট্ট নাই, অকালে বুড়িয়ে গেছেন। যুদ্ধের সময়কার কোন স্মৃতিই আজ আর তাঁর মনে নাই। তাতে কিছুই যায় আসে না- আমাদের তো মনে আছে। এও কী কম পাওয়া?
কিন্তু বারবার ঘুরেফিরে যে কথাটা বলছিলেন, 'আমার কোন টাকা-পয়সার দরকার নাই। আমার বাপেরে একটা খেতাব দিল না ক্যান? তাইনে কী দেশের লাইগা যুদ্ধ করে নাই'?

আমি আকাশপানে তাকিয়ে থাকি- একজন নপুংসক আর কী-ই বা করতে পারে...।
আমার কাছে অসংখ্য প্রশ্নের মতো এটারও কোন উত্তর নাই!

কতশত প্রশ্ন, এর উত্তর কে দেবে? বীরশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজনও সিভিলিয়ান নাই, কেন? একজন
কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা ঠেলা চালায়, কেন? আমি অতি সামান্য মানুষ হয়েও দুলা মিয়ার সেই ছোট্ট মেয়েটির খোঁজ এত বছর পরও বের করতে পারলে, এই দেশের দুর্ধর্ষ মিডিয়া ভাইয়ারা বেসুমার টাকা, হাতি-ঘোড়া থাকার পরও এই জজ সাহেবের খোঁজ আজ-অবধি বের করতে পারলেন না, কেন? একজন মুক্তিযোদ্ধা আত্মহত্যা করার জন্য ১৬ ডিসেম্বর বেছে নেন, কেন? তাঁর লাশ ১২ ঘন্টা গাছে ঝুলে থাকবে,
কেন? বীরাঙ্গনা রিনার এইসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে, এই মানুষটা আজ কোথায়? আমরা জানি না, কেন?
আসলে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ একটি পণ্য!

(এখানে বীরপ্রতীক আলমগীর সাত্তারের বক্তব্যটা প্রাসঙ্গিক বিধায় তুলে দিচ্ছি:
'...খেতাব দেয়ার সময় কেন এত কার্পণ্য করা হল? খেতাবপ্রাপ্তদের বেলায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যাই বেশী এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ সামরিক বাহিনীর সদস্য যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তাদের প্রশিক্ষণ ছিল পর্যাপ্ত। এরপরও আমি বলব, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারাই খেতাব পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বেশী। খেতাবপ্রাপ্তির ব্যাপারে সুপারিশ করার মত যাঁরা উচ্চপদে আসীন ছিলেন, তাদের অবহেলার কারণেই হয়েছে এমনটা।
...তবে ব্যতিক্রমি সেনানায়ক ছিলেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীফ অভ স্টাফ এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার। তার মত উদার যদি অন্য সেক্টর কমান্ডাররা হতেন, তাহলে অবশ্যই খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অনেক বেশী হত। অনেক সেক্টর কমান্ডারই মনে হয় বুঝতে পারেনি যে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ বারবার হয় না...।')

*আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই: দুলাল ঘোষ, সোহরাব হোসেনকে।
**ঋণ: 'দুধ বিক্রি করে শুটকি খাওয়া জাতি' এই বাক্যটা মাহাবুব আহমাদের। ঠিক তাঁরও না, তাঁর বাবার। তিনি তাঁর বাবার মুখে শুনেছিলেন।
***দুলা মিয়ার একটা
সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এইচ. এম. ইকবাল।

2 comments:

Sadiq Alam said...

This is very valuable work Shuvo bhai.

Emon said...

Shuvo bhai, apnake salam.