Search This Blog

Friday 9 January 2009

কর্নেল তাহের, তোমাকে কি স্পর্শ করতে পারি?

(২১.০৭.০৮ প্রথম আলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাহের সম্বন্ধে একটা শব্দও পাইনি বলে খানিকটা ধন্ধে আছি, সত্যিই কী এই দিনটিই তাঁর মৃত্যু দিবস ছিল? নাকি মুক্তচিন্তার দৈনিক দামি স্পেস নষ্ট করেনি! তাই যদি হয়, জয়তু মুক্তচিন্তা- বেঁচেবর্তে থাকো, ক্ষণে ক্ষণে মুক্তচিন্তা প্রসব করো! আমি বলি কি, চুতিয়ার খাতায় নাম লেখাও! )

আমি অবশ্য তাঁর মৃত্যুর দিনকে মৃত্যু দিবস বলে মনে করি না। আজ এই অগ্নিপুরুষের কেবল খোলস বদলাবার দিন। আসলে এমন অগ্নিপুরুষকে মেরে ফেলা যায় না, কারও সাধ্য নাই, যমেরও।
... ... ...
এমসি কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটা আর্মস স্ট্রাগল করার জন্য তিনি মিলিটারি ট্রেনিং নিতে আর্মিতে ভর্তি হবেন। ঠিক-ঠিক আর্মিতে জয়েন করলেন।
কমান্ডো মেজর আনোয়ার হোসেন (অব:) লিখেছিলেন এই অগ্নিপুরুষকে নিয়ে:
‌'১৯৬৭ সাল। আমি পাকিস্তানে ট্রেনিং নিচ্ছি। ওসময় পরিচয় কর্নেল (তৎকালীন মেজর) আবু তাহেরের সঙ্গে। কথাবার্তা হচ্ছিল বাংলায়:
কর্নেল তাহের: বাঙালী কমান্ডো তুমি?
আনোয়ার: ইয়েস স্যার।
কর্নেল তাহের: আমার খুব আনন্দ হচ্ছে তুমি কমান্ডো হচ্ছো, কিন্তু ভুলবে না, পরাধীন দেশ স্বাধীন করতে হবে।
আনোয়ার : স্যার, পরাধীন, পাকিস্তান তো স্বাধীন দেশ! কিসের কথা বলছেন বুঝতে পারছি না!
ক. তাহের (রাগী স্বরে): গোল্লায় যাক পাকিস্তান। তুমি একজন বাঙালী কমান্ডো, বুঝতে পারছ না কোন দেশ স্বাধীন করতে হবে?'
আনোয়ার স্তম্ভিত হলেন।
১৯৬৭ সালে বাঙালী নেতাদের মুখেও দেশ স্বাধীন করার কথা শোনা যেত না। অথচ একজন সৈনিক হয়ে কী দুর্দান্ত বিশ্বাস নিয়েই না উচ্চারণ করলেন।

একটা স্বপ্ন- জান্তব, অদেখা স্বপ্ন! এই স্বপ্ন কেবল অল্প ক-জন মানুষই দেখতে পায়, তাহের তাঁদের একজন।

কমান্ডো তাহেরের অসমসাহসিকতার বর্ণনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অতি সাহসী মানুষরাও তাঁর অতুল সাহসের কথা স্মরণ করে
এখনও শিউরে ওঠেন। নবীন কমান্ডোরা দূর থেকে তাহের নামের মানুষটাকে দেখে ফিসফিস করত, 'লুক, জেন্টলম্যান, দিস ইজ তাহের, আ লিজেন্ট ইন দ্য হিস্ট্রি অভ কামান্ডো ট্রেনিং। ...আ ম্যান ক্যান নট বী আ তাহের। হী ইজ আ সুপার, এক্সেপশনাল'।
তাঁর সার্টিফিকেটে লেখা ছিল, তিনি পৃথিবীর যে কোন দেশের, যে কোন সেনাবাহিনীর সঙ্গে, যে কোন অবস্থায়, অনায়াসে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম।

১৯৭১ সাল। রক্তাক্ত রণাংগন। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান আর্মি থেকে পালিয়ে আসেন। অমিত সাহস নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একটাই স্বপ্ন, সিংহাবলোকন ন্যায় তাহেরের, স্বাধীন দেশ।
পাক কমান্ডাররা তাহের সম্বন্ধে তাদের সৈনিকদের হুশিয়ার করে দিত, 'ইয়াংম্যান, বী আ্যওয়ার অভ তাহের। হী ইজ আ ভলকানো, আ হানড্রেড পার্সেন্ট এক্সামপল, প্রফেশনাল। সো সেভ ইয়্যুর স্কীন'।

তাহেরের বাঁ পায়ে গুলি লেগে গেল, রক্ত ঝরছে বিরামহীন। চেষ্টা করেও থামাননো যাচ্ছে না। তাঁকে উদ্ধার করতে ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত হেলিকপ্টার নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌছল।
উদ্ধারকারি মিত্র বাহিনীর অফিসারকে তাহের হা হা করে হাসতে হাসতে বললেন: 'এরা কী যুদ্ধ করবে, এরা আমার মাথায়ই গুলি লাগাতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই, এরা আটকাতে পারবে না, এদের এই ক্ষমতাই নাই'।

পরবর্তীতে এই তাহেরই বাংলার সাধারণ হাজার-হাজার কৃষকদের ট্রেনিং দিয়ে একেকজনকে দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপে গড়ে তুলেছিলেন। এই বিষয়টা অন্য কারও মাথায় খেলেনি। পরবর্তীতে দেখা গেছে, এই কৃষক-মজুর এঁরা একজন সৈনিকের চেয়ে অনেক ভালো করেছেন। কারণ এঁদের বুকে ছিল একরাশ দুর্দান্ত রাগ- চোখের সামনে এদেঁর কারও প্রিয়মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, কাউকে শারীরিককভাবে অপমান করা হয়েছিল, ধর্ষণ করা হয়েছিল।
... ... ...
এ অভাবনীয়, অভূতপূর্ব! তাহের এমন পিতা-মাতার সন্তান যারা তাঁদের ৭ পুত্র এবং ২ কন্যাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কর্নেল তাহের বীর উত্তম, তাঁর ভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম, শাখাওয়াত হোসেন, ওয়ারেসাত হোসেন বীর প্রতীক।
হায় তাহের, হায়- তোমাকে ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের কখ-খনো হবে না! এমন একজন অকুতোভয় মানুষকে, একটা স্বপ্নকে, সামরিক আদালতে বিচারের প্রহসনের নামে ফট করে মেরে ফেলা আমাদের দেশেই সম্ভব। আসলে ভীরু, কাপুরুষদের এটা করা ব্যতীত উপায় ছিল না। তাহেরকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় ছিল না। আফসোস, এই দেশ তার সেরা সন্তানদের কখনই ধরে রাখতে পারে না- অভাগা দেশ!

এ স্রেফ খুন! কর্নেল তাহেরকে খুন করা হয়েছিল। এবং এই খুন করার ধরন, নমুনা দেখে আমি বিস্মিত হই- গা বাঁচিয়ে কী চমৎকার ভঙ্গিতেই না খুন করা যায়! অনর্থক রসু খাঁকে আমরা দোষ দেই!

তাঁকে যেভাবে ফাঁসি দেয়া হয় প্রকারন্তরে এ খুনেরই নামান্তর। তাঁর ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যু করার মাত্র ৩ দিনের মাথায় ফাঁসি কার্যকর করা হয়। অথচ জেল কোড অনুযায়ী ডেথ ওয়ারেন্ট ইস্যুর ২১ দিন আগে বা ২৮ দিন পরে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিধান নাই।

একজন কথিত জল্লাদ জনাব মোঃ সিরাজউদ্দিনের সাক্ষৎকার নেয়া হয়েছিল, মিনার মাহমুদের বিচিন্তা পত্রিকায়:
"প্রশ্ন: ফাঁসির মঞ্চের কোনও ব্যক্তির আচরণ কি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে? যদি যায়, তবে সেই ব্যক্তিটি কে?
জল্লাদ সিরাজউদ্দিন: কর্ণেল তাহের। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি সহজভাবে কথা বলেছেন। একটা বিপ্লবী কবিতা পইড়া শোনাইছেন (জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে...)। আশ্চর্য! তিনি নিজের হাতে যমটুপি পরছেন। নিজেই ফাঁসির দড়ি নিজের গলায় লাগাইছেন। আমার মনে হয় ফাঁসির মঞ্চে এমন সাহস দুনিয়ার আর কেউ দেখাইতে পারে নাই।"

কাজলা গ্রামে, অযত্মে অবহেলায় শুয়ে থাকেন এই অগ্নিপুরুষ।
এ প্রজন্ম তাহেরকে কি কিছুই দিতে পারেনি, কি জানি! কিন্তু যখন দুর্বিনীত রাগী যুবকের উদ্ধত মাথা নুয়ে বুক ছুঁয়ে যায়, চোখ ভরে আসে জলে। চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেই হয় কিন্তু এ লজ্জা মুছে ফেলার চেষ্টা করে না সে। জলভরা চোখে তাহেরের অদেখা স্বপ্ন তাঁকে ছুঁয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, কমরেড, আমরা কী তোমায় স্পর্শ করতে পারি?
এ-ও কি কম পাওয়া, কিছুই না?

তাহেরের মত মানুষকে মেরে ফেলা যায় না, এঁরা খোলস বদলান কেবল। একটা স্বপ্নকে খুন করা যায় না, স্বপ্ন ফিরে আসে বারবার।
বাংলার এমন দামাল সন্তান বারবার ফিরে আসে এই ধান-শালিকের দেশে, মার কাছে। দুঃখি মা-টা হাহাকার নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন, কবে ফিরবে তার প্রিয় সন্তান...।

No comments: